সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি নিখোঁজের পর এবার রাজ পরিবারের পাঁচজন প্রিন্স নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেল। জামাল খাসোগির ঘটনায় যুবরাজের সমালোচনায় করায় রাজপরিবারের ওই সদস্যদের ‘গুম’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকা যুবরাজ খালিদ বিন ফারহান আল-সৌদ।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই দাবি করেছেন প্রিন্স খালিদ বিন ফারহান। জামাল খাসোগির আগে তিনিই সৌদি যুবরাজের রোষানলে ছিলেন বলেও মন্তব্য করেন। প্রিন্স ফারহান এখন স্বেচ্ছা-নির্বাসনে আছেন জার্মানিতে।
ফারহান ইন্ডিপেনডেন্টকে জানান, রাজপরিবারের ওই ৫ সদস্য আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আবদুল আজিজের নাতি। গত সপ্তাহে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রিন্সরা সাংবাদিক খাসোগি নিখোঁজের সমালোচনা করেছিলেন। এরপরই তাদের আটক করা হয় এবং তাদেরকে কোথায় রাখা হয়েছে তা জানা যায়নি।
ফারহান বলেন, ঠিক পাঁচদিন আগে কয়েকজন প্রিন্স সালমানের সঙ্গে দেখা করতে যান। তারা যুবরাজ সালমানকে বলেন, তারা আসলে সৌদি রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এ সময় তারা খাসোগির ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। পরের তাদের সবাইকে কারাগারের পাঠানো হয়।
গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে প্রবেশের পর সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসেননি খাসোগি।
সৌদি যুবরাজের মোহাম্মদ বিন সালমানের কড়া সমালোচক সৌদি সাংবাদিক খাসোগি গ্রেপ্তার আতঙ্কে এক বছর আগে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লিখতেন। ব্যক্তিগত কাগজপত্রের প্রয়োজনে ২ অক্টোবর সৌদি কনস্যুলেট ভবনে তিনি প্রবেশ করেন এবং সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসেননি। বলা হচ্ছে, সৌদি থেকে দুটি ব্যক্তিগত বিমানে আসা ১৫ সদস্যের একটি স্কোয়াড কনস্যুলেট ভবনের ভেতর খাসোগি হত্যায় অংশ নেয়। হত্যার পর ওই স্কোয়াড দ্রুত তুরস্ক ত্যাগ করে। তুরস্কের স্থানীয় দৈনিকগুলোয় ওই ১৫ জনের ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন ব্যক্তি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষ ইউনিটের সদস্য। এদের একজন সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর ফরেনসিক বিভাগের প্রধান।
ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাসোগি ‘হত্যার’ তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করেছে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে তাদের কাছে অডিও-ভিডিও, সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকার কথা জানিয়েছে দেশটি। এদিকে খাসোগি নিখোঁজের ঘটনা তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে তদন্তে সৌদি প্রতিনিধিদল গতকাল শুক্রবার তুরস্কে পৌঁছেছে।
শনিবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, ঘটনাটি তদন্তে যুক্ত তুর্কি গোয়েন্দা বিভাগের একজন বিবিসিকে জানিয়েছেন, খাসোগিকে হত্যার ব্যাপারে ‘তথ্য প্রমাণ’ রয়েছে তাঁদের কাছে।
ওয়াশিংটন পোস্টকে একটি সূত্র জানিয়েছে, খাসোগিকে মারধরের শব্দ শোনা গেছে। রেকর্ডিং থেকে বোঝা গেছে, খাসোগিকে হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। আরেকটি সূত্র ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছে, খাসোগি এবং আরবি ভাষায় কথা বলা বেশ কয়েকজন মানুষের আওয়াজ পাওয়া গেছে। খাসোগিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে।
খাসোগি নিখোঁজ, কিন্তু তাঁর হত্যার ব্যাপারে নিশ্চিত তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। এরপরও তুরস্ক সরকার সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘটনাটি যৌথভাবে তদন্ত করতে রাজি হয়েছে। সৌদির একটি প্রতিনিধিদল গতকাল তুরস্কে পৌঁছেছে। সপ্তাহজুড়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার সৌদি রাজপরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রিন্স খালেদ আল-ফয়সাল তুরস্কে এসেছিলেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট সমাধানের চেষ্টা করছেন। তাঁর সফরের সময় দুই দেশের যৌথ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে সৌদি কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সৌদির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থায় প্রকাশিত খবর অনুসারে, সৌদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ আবদুলাজিজ বিন সৌদ বিন নাইফ বিন আবদুলাজিজ আল সৌদ বলেছেন, ‘তাঁকে (খাসোগি) হত্যার নির্দেশ দেওয়ার তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ।’ তাঁর ভাষায়, সৌদি চায়, ঘটনার ‘পুরো সত্য’ বেরিয়ে আসুক।
যাঁর দিকে অভিযোগের তির, সেই ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ব্লুমবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খাসোগি নিখোঁজের ঘটনায় সৌদি আরবের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। খাসোগি ওই দিন কনস্যুলেট ভবনে এসেছিলে স্বীকার করে তিনি বলেন, কাজ শেষে খাসোগি কনস্যুলেট ভবন থেকে বেরিয়েও গেছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, খাসোগি ‘বেরিয়ে গেছেন’ বলে দায় এড়াতে পারে না সৌদি আরব।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা জারেদ কুশনারের সঙ্গে ক্রাউন প্রিন্সের এখন সুসম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খুব একটি উচ্চাবাচ্য করতে না চাইলেও সিনেটের ক্রমাগত চাপের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। বুধবার বব কোর্কারের নেতৃত্বে মার্কিন সিনেটে দ্বিদলীয় ২২ জন সিনেটর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ চেয়ে একটি চিঠি স্বাক্ষর করেছেন। খাসোগির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তাঁর তদন্ত চেয়েছেন তাঁরা।