রবিবার, ২২ Jun ২০২৫, ০৪:২৬ অপরাহ্ন

ঈমান ভঙ্গের অন্যতম ১০টি কারণ

ঈমান ভঙ্গের অন্যতম ১০টি কারণ

সোহেল রানা

ওযু ও নামায ভঙ্গের কারণ জানি কিন্তু ঈমান ভঙ্গের কারণ কি জানি? প্রতিটা মুমিনের নামাজ শুরু করা বা অজু করার পর কিছু কাজ করলে যেমন নামাজ বা অজু নষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ঈমান আনার পর কিছু কথা, কাজ ও বিশ্বাস আছে, যা করলে বা পোষণ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।  ঈমান ভঙ্গের কারণগুলো মূলত তিন প্রকার। বিশ্বাসগত, কর্মগত এবং উক্তিগত।  প্রত্যেক মুমিনের জন্য অবশ্যই ঈমান ভঙ্গের এই মৌলিক কারণগুলো জানা অতীব জরুরি।

ঈমান ভঙ্গের অন্যতম দশটি কারণ-

একঃ আস-শিরক- আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করা-

যদি কোনো মুমিন-মুসলমান উপাস্য বা ইলাহ হিসেবে বা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে।  বর্তমান কালের কয়েকটি বড় বড় শিরক সমূহের মধ্যে রয়েছে যেমন- আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সেজদা করা, মাজারে গিয়ে মাজারওয়ালার কাছে কিছু চাওয়া।  মাজার ও কবর পূজা, পীর ও আল্লাহর অলিরা গায়েব জানেন, অসুস্থকে সুস্থ করতে পারেন, বাচ্চা দিতে পারেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন কিংবা আমাদের সকল খবর জানেন ইত্যাদি ধারণা পোষণ করা।  আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য স্থির করো না।’ (সুরা ইসরাইল, আয়াত: ২২) এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ৪৮, সুরা মায়িদার ৭২, সুরা আনআমের ৮২, সুরা শুআরার ৯৭-৯৮, সুরা জুমারের ৬৫, সুরা তাওবার ৫, সুরা ইউনুসের ১৮ এবং সুরা আনকাবুতের ৬৫ নম্বর আয়াতেও এ ধরনের আলোচনা রয়েছে।

দুই: মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ধরা বা মধ্যস্থতাকারী মনে করা-

যে নিজের এবং আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতা বা যোগাযোগের মাধ্যম বানায় এবং যদি আল্লাহকে ডাকা বা তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যম গ্রহণ করেন এবং সে মাধ্যমকে শাফায়াতের যোগ্য মনে করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে।  এ কথা মনে করা যে, নিজে চাইলে পাওয়া যাবে না, পীর,মাজারে, কবরে থাকা বুজুর্গ ব্যাক্তি চেয়ে দিলে পাওয়া যাবে।  আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বলুন! সমস্ত সুপারিশ একমাত্র আল্লাহর আওতাধীন।  আসমান ও জমিনে তাঁরই সাম্রাজ্য। (সুরা জুমার, আয়াত: ৪৪) মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ব্যতীত যার ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না।  তারা বলে, এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী -সুরা ইউনুস- ১৮।  ‘জেনে রাখো, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে- আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে।’ তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দেবেন।  যে মিথ্যাবাদী ও কাফির আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’ (সূরা জুমার ৩)।  এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা সাবার ২২-২৩, সুরা মরিয়মের ৮১-৮২, সুরা শুআরার ১০০-১০১, সুরা আম্বিয়ার ২৮ এবং সুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতেও আলোচনা রয়েছে।  রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ–তাআলার কাছে প্রার্থনা করে না, তিনি তার ওপর রাগান্বিত হন।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৭৩)

তিন: কাফির-মুশরিকের মতবাদকে সঠিক মনে করা-

যে ব্যক্তি বহু্ইশ্বরবাদকে প্রত্যখান করেনা।  এবং যদি কোনো কাফির বা মুশরিককে কাফির–মুশরিক মনে না করেন এবং তাদের মতবাদকে সঠিক মনে করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে।  আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আহলে কিতাবিদের মাঝে যারা কুফরি ও শিরক করে; তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামি এবং তারাই সৃষ্টির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি। (সুরা বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৬)।  আবু মালিক (রা.)-এর পিতা বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘ যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলল এবং আল্লাহর ছাড়া বাকি সব উপাস্যকে অস্বীকার করল, তার সম্পদ ও রক্ত অন্য মুসলিমের জন্য নিষিদ্ধ।  আর তার প্রকৃত হিসাব-নিকাশ আল্লাহর দায়িত্বে। (মুসলিম, হাদিস: ২৩)।  এ ছাড়া এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৩০-২৫৫, মুমতাহিনার ৪ নম্বর আয়াতে আলোচনা রয়েছে।

চার: নবী করিম (স.) এর আনিত কোনো বিধানকে অপছন্দ করা-

নবী করিম (সা:) এর আনীত সংবিধানের চেয়ে অন্য কোনো সংবিধানকে পূর্ণাঙ্গ মনে করা কিংবা অন্য কোনো সংবিধানকে ইসলামের সংবিধান থেকে উত্তম মনে করা।  যেমন- বর্তমান যুগে ইসলামের বিধানকে অচল মনে করা।  ইসলামের বিধানকে বর্বর বলে আখ্যায়িত করা, আর মানবরচিত সংবিধানকে উত্তম ও যুগোপযোগী মনে করা।  আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো কাজের আদেশ করলে, কোনো ইমানদার নারী-পুরুষের জন্য সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অধিকার নেই।  আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ অমান্য করে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ৩৬)।  জাবির (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে উত্তম আলোচনা হলো আল্লাহর কিতাব এবং সবচেয়ে উত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শ। (মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭)।  এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা নাজমের ৩-৪, সুরা মায়িদার ৩-৪৪, সুরা আলে ইমরানের ৮৫, সুরা আনআমের ৫৭ এবং সুরা নিসার ৬০-৬৫ নম্বর আয়াতেও আলোচনা আছে।

পাচ: ইসলামের কোনো বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দেওয়া কোনও বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা ঈমান ভঙ্গের কারণের একটি।  যেমন- দাড়ি, টুপি বা মেসওয়াক নিয়ে হাসি-ঠাট্টা বিদ্রূপ করা।  পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আপনি তাদের প্রশ্ন করলে তারা নিশ্চয়ই বলবে, ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও ক্রীড়া-কৌতূক করছিলাম।’ বলেন, ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসুলকে বিদ্রূপ করছিলে?’ তোমরা অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করো না।  তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরি করেছ।” (সুরা তওবা: ৬৫-৬৬)।  আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর যারা কাফির তাদের জন্য রয়েছে দুর্গতি এবং তিনি (আল্লাহ) তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দেবেন।  এটা এ জন্য যে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তারা তা অপছন্দ করে।  সুতরাং আল্লাহ তাদের নিষ্ফল করে দেবেন’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৮-৯)

ছয়:  ইসলামের কোনো বিধানকে অপছন্দ করা-

যেমন- পর্দার হুকুমকে অপছন্দ করা কিংবা উপযুক্ত ব্যক্তির একাধিক বিয়েকে অপছন্দ করা। এমনিভাবে জিহাদ বা আল্লাহর পথে সংগ্রামকে অপছন্দ করা।  মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে বিচারক বলে মনে না করে।  এরপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সঙ্কীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে’ (সূরা নিসা ৪ : ৬৫)।

সাত:  মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সমর্থন ও সহযোগিতা করা

মুসলিমদের বিরুদ্ধে গিয়ে মুশরিকদের সমর্থন ও সহযোগিতা করলে ঈমান ভেঙ্গে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পিতা ও ভাইও যদি ঈমানের বিপরীতে কুফরিকে বেছে নেয়, তবে তাদের অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না।  তোমাদের মধ্যে যারা তাদের অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে, তারাই সীমা লঙ্ঘনকারী।’ (সুরা তাওবা: ২৩)।  ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।  তারা পরস্পরের বন্ধু।  তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন বলে গণ্য হবে।  নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সুরা মায়েদা: ৫১)

আট : আস সিহর বা জাদু করা-

সকল প্রকার যাদু নিষিদ্ধ, কেউ এতে অংশগ্রহণ করুক, সময় ব্যয় করুক বা চর্চার প্রতি সহানুভূতিশীল হোক না কেন।  যে ব্যক্তি জাদু চর্চা করে বা জাদুতে খুশী হয়, সে কাফির হয়ে যায়।  কারণ আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন: সুলায়মান কুফরী করে নাই কিন্তু শয়তানরাই কুফরী করেছিল, তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত।”(সূরা বাকারা ২ : আয়াত ১০২)

নয়: কাউকে দ্বীন-শরিয়তের ঊর্ধ্বে মনে করা-

যেমন- মারেফতের ধোঁয়া তুলে নিজেকে ইসলামের হুকুম আহকামের ঊর্ধ্বে মনে করা।  বাতেনিভাবে নামাজ-রোজা আদায়ের কথা বলা।  মহান আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়িদা ৫ : ৩)।

দশ: দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া

দ্বীনের হুকুম আহকামকে অযোক্তিক বা বোঝা মনে করা- আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি দ্বারা উপদিষ্ট হয়েও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার অপেক্ষা অধিক অপরাধী আর কে? আমি অবশ্যই অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকি’ (সূরা সাজদা ৩২ : ২২)।

উপরে উল্লিখিত প্রত্যেকটি কারণ এমন, যার একটি যদি কারো মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তার ঈমান ভেঙে যাবে বা তার ইসলামকে অকার্যকর করতে পারে এবং যদি সে তার ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে (তওবা) অনুতপ্ত না হয় এবং সে মৃত্যু বরণ করার আগে আবার ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে সে একজন মুশরিক (পৌত্তলিক) বা একজন কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, আর তার গন্তব্যস্থল হবে অনন্ত কালের জন্য দোজখের আগুন এবং কোনদিনও জাহান্নামের আগুন থেকে বের করা হবে না।  মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিফাজত করুন।  আমীন।





© All rights reserved © 2017 alltimenewsbd24.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com